বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার নাম কিশোরগঞ্জ। এ জেলার অধীনে মোট ১৩টি উপজেলা ও ১১৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। জনঘনত্ব প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার। এর অধীনে ৮টি পৌরসভা বাকী ১০৮টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। জেলায় মোট ৮৪টি ভূমি অফিসে সহকারী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ৫০ জন।
ভৌগলিক আয়তনের দিক থেকে প্রায় ২৬৮৮ বর্গ কিলোমিটার। প্রাচীন জনপদ, একাধিক পৌরসভা এবং হাওর বেষ্টিত এই জেলাটিতে সদরসহ নিকলী, কটিয়াদী, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনসহ ৫ উপজেলাতেই বেশ কিছুদিন যাবত সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসার কর্মস্থলে না থাকায় সেবা প্রত্যাশীদের হাহাকারের তথ্য চিত্র উঠে আসে সরেজমিনে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ২০২০ সালের ১৬ জুন মাসে জনসেবায় জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পায় এই ভূমি মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয় পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০ বিজয়ী হিসেবে বিশ্বের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান এই ভূমি মন্ত্রণালয়। তবুও লোকবল সংকটে আর সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদের মাঝে রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই সীমাহীন হয়রানির অভিযোগ। গুঞ্জন রয়েছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটার বিষয়েও।
আলোচনা রয়েছে এই সেক্টরে নারী অফিসারের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। যে কারণে কিশোরগঞ্জ সদর ও বাজিতপুরের ন্যায় নারী অফিসারদের বেলায় যখন এই জনগুরুত্বপূর্ণ পদে ৬ মাস মাতৃকালীন নিয়মিত ছুটিতে যায় তখন এই সেক্টরের সেবা প্রত্যাশীদের অভিযোগের চিত্রটা ব্যতিক্রমী হয়ে থাকে। অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকারা একাধিক দাপ্তরিক কাজ পালনেও হিমসিমে থাকে বলে জানা যায়। এ সময়ে হয়রানির আর অনিয়মের তথ্যও অধিক হয়ে থাকে বলে জানান স্থানীয় ভুক্তভোগীরা।
জেলা অফিস প্রশাসন সূত্রের দাবি লোকবল সংকটের কারণে যথা সময়ে সঠিক সেবার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে থাকে। এছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকাদের কষ্ট তখন বেড়ে যায় আর সঠিক সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময় বিলম্ব হয়ে থাকে। তবে অচিরেই এই সমস্যা সমাধানে হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে এই সেক্টরের নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে বলে কমিশন থেকেই কর্মস্থলের চুড়ান্ত নিয়োগ হয়। তবে ভূমি মন্ত্রণালয় অফিস সূত্র স্বীকার করে লোকবল সংকটের ততটা সমস্যা থাকার কথা নয় যতটা কিশোরগঞ্জের চিত্র। তবে বিতরণ বিষয়ে দেখার চেষ্টারও ইঙ্গিত করেন।
বিভিন্ন উপজেলায় অসংখ্য ভূমি সেবা প্রত্যাশীদের ভাষ্যমতে শুধূ পাঁচ উপজেলাতেই নয় চক্রাকারে একেকবার যখন একেক উপজেলায় এই পদে কর্মস্থলে লোক না থাকে তখন সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় সেবা নিতে আসা লোকজনকে। এই সেক্টরের ভোগান্তি নিয়ে সচেতন মহলের ভাষ্য ভূমির এই সেক্টর আন্তর্জাতিকভাবে সেবার মানে সনদ পেলেও ভোগান্তিরও সীমা নেই। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের পাঁচ উপজেলার মতো যখন অন্যান্য উপজেলাতেও সহকারী ভূমি কমিশনার বিহীন চলে তখন সেবা প্রত্যাশীদের ভোগান্তি বেড়ে যায়।
এছাড়াও এই সেক্টরের স্থানীয় পর্যায়ে দেখানো হচ্ছে সার্ভার জনিত ত্রুটির বিষয়। স্থানীয় অফিসগুলো মাসের পর মাস ঘুরছেন অসংখ্য সেবা প্রত্যাশীদের। জারইতলা ইউনিয়নের ধারীশ্বর গ্রামের সৈয়দ রিয়াজুল হকের মতো কেউ অনলাইনে খাজনা দিতে চাইলে দিতে এসে ব্যর্থ হচ্ছেন। স্থানীয় সহকারী ভূমির নায়েব সাফি উদ্দিনের মতো অন্যান্যরাও ইন্টারনেট সার্ভার সার্ভিস জনীত সমস্যার চিত্র তুলে ধরে বিদায় করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও অনলাইন সম্পর্কে যাদের ধারনা নেই তাদের ভোগান্তি আর অভিযোগ যেনো চরমে।
বাজিতপুরের দিলালপুর ও জারইতলা ইউনিয়নের ন্যায় বেশ কিছু ভূমি অফিসে দেখা মিলে ভ্রাম্যমান লোকদেরকে বসিয়ে অনলাইনে আবেদনের কথা বলে তাদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন নামজারির চলে। নানান অজুহাতে ঘুমাচ্ছেন মাসের পর মাস। বাজিতপুর উপজেলার গাজিরচর ইউনিয়নের সৌমিক মিয়ার মতো অসংখ্য সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা এমনি তথ্য তুলে ধরেন সরেজমিনে। তবে একাধিক ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের দাবি এখন আর এসব অনিয়ম হয় না। বহিরাগতদের মাধ্যমে ভূমি সেবার সুযোগ নেই। তাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লেনদেন বিষয়ে কোন ধরনের রফাদফার সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষিত যুবক বলেন, আন্তর্জাতিক সনদপ্রাপ্ত এই সেক্টরেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি অতীতের ন্যায় এখনো হচ্ছে। সরকারিভাবে ১১৭০ টাকার বিনিময়ে নামজারি সুবিধা থাকলেও সরেজমিনে নামজারি করতে এলেই নানান ত্রুটি দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কৌশলে মোটা অংকের টাকা। টাকা না দিলে সহজে নামজারি মিলে না বলে জানান। সবার দ্বারা অনলাইনে নামজারি করা নানান কারণে জটিলতা বলেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ।
নিকলী উপজেলার জারইতলা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. সাফি উদ্দিন আহমেদ এক প্রশ্নের জবাবে স্বীকার করেন সার্ভার জনীত সমস্যার কারণে যথাযথ সময়ে সঠিক সেবা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকেই। তবে চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর এখানে যোগাদানের পর থেকে কোন বহিরাগতদের অর্থনৈতিক ফায়দা লুটার সুযোগ দেননি বলেও তিনি দাবি করেন।
সরেজমিনে নিকলী বাজিতপুরের ১৪টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘুরে দেখা গেছে এ সবের মধ্যে মাত্র ৮টিতে ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা রয়েছেন। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকজন অল্প সময়ের মধ্যেই অবসরে যাচ্ছেন বলেও অফিস সূত্র নিশ্চিত করে। জানা গেছে নিকলীর কারপাশাতেও বেশ কিছুদিন ধরেই সহকারী কর্মকর্তা নেই। এছাড়াও বাজিতপুর পৌরসভা, হিলচিয়া ও দীঘির পাড় ইউনিয়ন ভূমি অফিস ব্যতীত বাকী ৫টি ভূমি অফিসেও সহকারি কর্মকতা নেই বলে জানা গেছে।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাহীদ হাসান খান এক প্রশ্নের জবাবে, কিশোরগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় সাম্প্রতিক সহকারী কমিশনার ভূমি না থাকায় সেবার মান নিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে স্বীকার করেন। তবে আশাবাদ ব্যক্ত করে চলেছেন কর্মস্থলে জানুয়ারিতে নিয়োগ দিয়ে দিলেই এই সমস্যাও সমাধান হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে এই সেক্টরে লোকবল সংকটের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
ভূযি মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. মাহমুদ হাসানের সাথে এই সেক্টরের লোকবল সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জবাবে সব জেলায় ততটা সংকট না থাকার বিষয় উল্লেখ করেন। পাশাপাশি জেলার দায়িত্বে থাকাদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলারও পরামর্শ দেন। জাতিসংঘের অধীনে বিশ্বের সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ভূমি সেক্টরে সেবার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০ পুরস্কার পেয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে এই সেক্টরে দীর্ঘদিনের সার্ভার জনীত সমস্যার চিত্র তুলে ধরতেই জবাব এড়িয়ে পুনরায় স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বে থাকাদের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
Leave a Reply